শিক্ষার্থীদের আত্মহনন ঠেকাতে উদ্যোগ কম


   

শিক্ষার্থীদের আত্মহনন ঠেকাতে উদ্যোগ কম


রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ইমরুল কায়েসের বাড়ি যশোরের ঝিকরগাছায়। বছর দুয়েক আগে থেকে তার মধ্যে বিষণ্ণতার চাপ দেখতে পান একই বিভাগের শিক্ষক সাজ্জাদ বকুল। এ অবস্থায় গত বছরের শুরুর দিকে রাজশাহীতে মনোবিদ ডা. মামুন হুসাইনের কাছে ওই শিক্ষার্থীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন সাজ্জাদ বকুল। সে থেকেই ইমরুল কায়েস ডা. মামুন হুসাইনের তত্ত্বাবধানে ছিলেন। করোনা মহামারিতে ক্যাম্পাস বন্ধ হওয়ায় গ্রামের বাড়িতে চলে যান ইমরুল। এর মধ্যে গত ২৪ সেপ্টেম্বর রাতে থেমে যায় তার জীবন। ঘটনার পর শিক্ষক সাজ্জাদ বকুল ওই শিক্ষার্থীর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন, ক্যামেরা কিনতে ৫০ হাজার টাকা দাবি করেছিল।

এর আগে তার চাপাচাপিতে মোটরসাইকেল কিনে দিতে বাধ্য হন মা-বাবা। মোটরসাইকেলের জন্যও আত্মহননের হুমকি দিতেন। জেদ ও না পাওয়ার হতাশায় নিজের জীবন নিজেই থামিয়ে দিলেন।

শুধু ইমরুল কায়েস নন, গত সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে চার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ভয়ংকর এই পথে হেঁটেছেন। এর মধ্যে তিনজনই বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী। সেপ্টেম্বর মাসে আত্মহত্যা করেছেন আরও তিন শিক্ষার্থীসহ সাতজন। এভাবে গত বছরের মার্চ থেকে এ বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৯ মাসে ১৮০ শিক্ষার্থী আত্মঘাতী হয়েছেন বলে বিভিন্ন সূত্র নিশ্চিত করেছে। নিহত শিক্ষার্থীদের পরিবার ও সহপাঠীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনার কারণে ক্যাম্পাস বন্ধ থাকা, বিষণ্ণতা, অবসাদ, পারিবারিক জটিলতা, আর্থিক সংকট, কিছু পাওয়ার জেদ, না পাওয়ার হতাশা, পড়াশোনার চাপ, শিক্ষাজীবন নিয়ে হতাশা, মানসিক নির্যাতন, সম্পর্কের টানাপোড়েন এবং চাকরি নিয়ে অনিশ্চয়তার কারণে তারা আত্মহননের পথ বেছে নেন।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা বৃদ্ধির প্রবণতার কথা বললেও অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যথাযথ কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরামর্শদান দপ্তরও আত্মহত্যা-সংক্রান্ত কোনো তথ্য সংরক্ষণ করে না। আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে থাকা মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোও জনবল সংকটে চলছে ঢিমেতালে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিষণ্ণতাগ্রস্ত ব্যক্তিকে একা না রাখা, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সময় কাটানো, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাউন্সেলরসহ মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা এবং কোনো একটি অভাব পূরণ না হওয়া মানে জীবন শেষ নয়- এই উপলব্ধিসহ অনুকূল পরিবেশ গড়ে তুলতে পারলে আত্মহত্যা প্রবণতা রোধ করা সম্ভব।

করোনাকালে সবচেয়ে বেশি: তরুণদের সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের এক জরিপের তথ্যমতে, ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ৪ জুন পর্যন্ত দেশে ১৫১ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এর মধ্যে ৭৩ স্কুল শিক্ষার্থী, ৪২ জন বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী, ২৭ জন কলেজ শিক্ষার্থী এবং ২৯ জন মাদ্রাসার শিক্ষার্থী রয়েছেন। যদিও এ সংখ্যা ২০১৮ সালে ১১ জন ও ২০১৭ সালে ১৯ জন ছিল। গত জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২৪ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন বলে সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা গেছে। সব মিলিয়ে গত ১৯ মাসে ১৮০ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন বলে তথ্য পাওয়া যায়।

পাঁচ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা: করোনাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৩ জন বর্তমান এবং একজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নির্দেশনা ও পরামর্শদান দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক অধ্যাপক ড. মেহজাবীন হক সমকালকে বলেন, শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন করতে বিভিন্ন কর্মশালার আয়োজন করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে টেলিফোন নম্বর দেওয়া আছে। ৩০ জন কাউন্সেলর পার্টটাইম এবং একজন স্থায়ীভাবে কাজ করেন। তবে শিক্ষার্থীরা যোগাযোগ করে না। জানতে চাইলেও তারা সাড়া দেয় না।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ১০ বছরে ১১ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। তার মধ্যে ছয়জন মেয়ে ও পাঁচজন ছেলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের তথ্যমতে, ১২ হাজার ৯২১ শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছেন দু'জন সাইকোলজিস্ট ও একজন কাউন্সেলিং অফিসার। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কল্যাণ ও পরামর্শদান কেন্দ্রের সহকারী পরিচালক (মনোবিজ্ঞান) ইফরাত জাহান বলেন, নিয়মিত কাউন্সেলিং ও সচেতনতার জন্য অনলাইনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করছি। শিক্ষার্থীদের তুলনায় লোকবল কম। কোনো সাইকিয়াট্রিস্ট নেই।

গত দেড় মাসে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চার শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। অবসাদগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই কোনো মানসিক হেলথ কেয়ার সেন্টার। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকল্যাণ দপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক ড. আইনুল ইসলাম বলেন, শিক্ষার্থীদের চিকিৎসার জন্য মেডিকেল সেন্টারে সাইকোলজিস্ট নিয়োগ দেওয়া হবে। এ ছাড়া প্রতিটি বিভাগে শিক্ষার্থীদের সমস্যা শোনার জন্য একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষক থাকবেন। উপাচার্য বিদেশ থেকে দেশে ফিরলেই এ কার্যক্রম শুরু হবে বলে জানান তিনি।

গত পাঁচ বছরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ছয় শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক আনওয়ারুল হাসান সুফি বলেন, বর্তমানে ৬৫০ শিক্ষার্থী চিকিৎসা নিচ্ছে। এদের মধ্যে ২১৭ জন একাধিকবার আত্মহত্যার প্রস্তুতি নিয়েছিল। প্রতিদিন গড়ে ৯ জন শিক্ষার্থী চিকিৎসা নিতে আসে। তিনি জানান, রাবির মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মাত্র চারজন মনোবিজ্ঞানী দিয়ে চিকিৎসা চলছে। যার মধ্যে সবাই অবৈতনিক দায়িত্ব পালন করছেন।

গত এক দশকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সাত শিক্ষার্থী ও এক শিক্ষক আত্মহত্যা করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি বিপ্লব কুমার দে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারের দোতলায় একটি কাউন্সেলিং কেন্দ্র করা হলেও এখন কার্যক্রম বন্ধ। পেশাদার সাইকোলজিস্ট নিয়োগ দেওয়া জরুরি।

নেই কাউন্সেলিংয়ের পর্যাপ্ত সুযোগ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ড. নেহাল করিম বলেন, তরুণদের আত্মহত্যার দিকে ধাবিত করার পেছনে প্রকৃত সমস্যা চিহ্নিত করতে পারার মতো কোনো মানসম্পন্ন গবেষণা নেই।

মানসিক সমস্যায় ভুগতে থাকা শিক্ষার্থীদের জন্য মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসাকে অত্যাবশ্যকীয় উল্লেখ করে বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ড. মেহতাব খানম বলেন, বাংলাদেশে পর্যাপ্ত মনোবিদ এবং মনোচিকিৎসক নেই। দেশে প্রায় ৩০০ মনোচিকিৎসক এবং ৫০০ জনের কম মনোবিদ রয়েছেন। সরকারের অবশ্যই পাঠদানের ক্ষতিপূরণ এবং মানসিক সমস্যায় জর্জরিত শিক্ষার্থীদের সহায়তার উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত। অন্যথায় ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সম্ভাবনা হারাতে বসবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারপারসন অধ্যাপক মাহফুজা খানম বলেন, অভিভাবকদের নজরদারি বাড়াতে হবে। মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে বন্ধুসুলভ আচরণ করতে হবে।

আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা তানসেন রোজ বলেন, মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর আরও গুরুত্ব দিয়ে নাগরিকের বেঁচে থাকার পরিবেশ তৈরি রাষ্ট্র ও পরিবারের দায়িত্ব। তরুণ প্রজন্ম, বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে হারে আত্মহত্যা বাড়ছে, সে হারে সচেতনতা বাড়ছে না। আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তিকে একা না রাখা, ক্রাইসিস সেন্টার ও হটলাইন চালু করা, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাউন্সেলর নিয়োগ করার ওপর জোর দেন তিনি।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট এবং হাসপাতালের শিশু-কিশোর ও পারিবারিক সম্পর্ক বিভাগের চিকিৎসক হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, স্কুলগুলোতে নিয়োগ দেওয়ার মতো বাংলাদেশে অত চাইল্ড সাইকোলজিস্ট নেই। তাই প্রয়োজন শিক্ষকদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া।

এদিকে, শিক্ষার্থীদের মানসিক সমস্যা দিন দিন বাড়তে থাকলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয় এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। এ বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক বলেন, করোনার কারণে নিয়োগ প্রক্রিয়া থেমে ছিল। পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হলে মনোচিকিৎসক নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

Post a Comment

0 Comments