এস পি সি ও কিউকম হাতিয়ে নিয়েছে ৫১৮ কোটি টাকা


 

ডিবি ও সিআইডির অভিযানে সিইওসহ গ্রেপ্তার ৩

'বিজয় আওয়ার', 'স্বাধীনতা আওয়ার', 'বিগ বিলিয়ন', 'ঈদ ধামাকা', 'সাইক্লোন'- এ রকম নামে বহু অফার দিয়ে গ্রাহকের অন্তত ৫১৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বিতর্কিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান কিউকম ও এসপিসি ওয়ার্ল্ড। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা প্রতিষ্ঠান দুটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাসহ (সিইও) তিনজনকে গ্রেপ্তারের পর এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে।


গত রোববার রাতে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) মতিঝিল বিভাগের একটি দল রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে কিউকমের সিইও রিপন মিয়াকে। একই রাতে বেইলি রোড এলাকা থেকে সিআইডি গ্রেপ্তার করে এসপিসি ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মো. আল আমীন এবং তার স্ত্রী প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক শারমীন আক্তারকে।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, কিউকম ২০১৯ সালে কার্যক্রম শুরু করে নানা অফারের নামে গ্রাহকের অন্তত ২৫০ কোটি টাকা হাতিয়েছে। আর এসপিসি ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেসের মালিক আল আমীন ২৬৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে গেল বছর গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। ওই ঘটনায় জামিনে বের হলেও গ্রাহকের মামলায় ফের গ্রেপ্তার হলেন স্ত্রীসহ। এই আল আমীন এক সময়ে বহুল আলোচিত এমএলম কোম্পানির ডেসটিনির শীর্ষ কর্মকর্তাদের একজন ছিলেন।

গতকাল সোমবার দুপুরে রাজধানীর মিন্টো রোডে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন করে কিউকমের সিইওকে গ্রেপ্তারের তথ্য দেন ডিবির কর্মকর্তারা। সেখানে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, মোটরসাইকেল কেনার জন্য টাকা দেওয়ার পরও সময়মতো না পাওয়ায় একজন ক্রেতা রোববার পল্টন থানায় কিউকমের মালিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলায় রিপনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই মামলায় প্রতারণারও অভিযোগ আনা হয়েছে।

তিনি বলেন, রিপনকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সে প্রায় ২৫০ কোটি টাকার পণ্যের ডেলিভারি আটকে থাকার তথ্য দিয়েছে। তা ছাড়া তার প্রতিষ্ঠান লক্ষাধিক পণ্য অনলাইনে বিক্রি করে বলেও দাবি করেছে। যদিও দশ দিনের মধ্যে পণ্য সরবরাহের কথা বলা হলেও তিন-চার মাস পরও পণ্য দিচ্ছিল না তারা।

ডিবির এই কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক গত জুন মাসে 'এসক্রো সিস্টেম' চালু করে। এই সার্ভিসে দু'পক্ষের লেনদেনের সময় তৃতীয় পক্ষের কাছে অর্থ বা সম্পদ জমা রাখতে হয়। পণ্য বা সেবা বুঝে পাওয়ার পরই কেবল তার মূল্য পান বিক্রেতা। এ ব্যবস্থায় ক্রেতা পণ্যের দাম অগ্রিম দিলে তা চলে যায় বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদিত পেমেন্ট গেটওয়ের কাছে। কিউকমের পেমেন্ট গেটওয়ে ছিল 'ফস্টার'। কিউকম ক্রেতাকে পণ্য বুঝিয়ে দিয়ে চালানসহ নথিপত্র ফস্টারের কাছে জমা দিত। ফস্টার তখন ক্রেতাকে ফোন করে নিশ্চিত হতো তিনি টাকা বুঝে পেয়েছেন কিনা। এরপর কিউকম পণ্যের টাকা বুঝে পেত। কিন্তু কিউকম গ্রাহকের পণ্য ঠিকমতো বুঝিয়ে না দেওয়ায় ফস্টার বাংলাদেশ ব্যাংকের 'প্রুফ অব ডেলিভারি' নির্দেশনা অনুযায়ী তাদের টাকা আটকে দেয়। ফলে ক্রেতা পণ্য বা টাকা কোনোটাই আর পাননি।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, কিউকমের ৩৯৭ কোটি টাকা ফস্টারের কাছে জমা আছে বলে রিপন জানিয়েছে। এই জমা টাকা থেকে কিউকমের গ্রাহকরা টাকা ফেরত পেতে পারেন। তবে এর বাইরেও মোটরসাইকেল দেওয়ার কথা বলে প্রতিষ্ঠানটি ২৫০ কোটি টাকা মেরে দিয়েছে।

গতকাল রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয়ের সামনে গ্রাহকের ভিড় দেখা যায়। তবে কার্যালয়টি বন্ধ ছিল। সেখানে দায়িত্বরত নিরাপত্তা কর্মী হুমায়ুন কবির জানান, গত কয়েকদিন ধরেই প্রতিষ্ঠানটির কেউই অফিসে আসছেন না।

রিপন রিমান্ডে :প্রতারণা ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান কিউকমের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) রিপন মিয়াকে দুই দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছেন আদালত। ঢাকা মহানগর হাকিম আশেক ইমাম গতকাল সোমবার শুনানি শেষে রিমান্ডের আদেশ দেন।

এর আগে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মতিঝিল জোনাল টিমের (ডিবি) এসআই আ. মালেক পল্টন থানায় দায়ের করা প্রতারণা ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় এ আসামিকে আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে রিপন মিয়ার দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।

ডেসটিনি থেকে শিক্ষা :গতকাল দুপুরে রাজধানীর মালিবাগে সিআইডির কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন এসপিসি ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেসের সিইও আল আমীন ও পরিচালক শারমীন আক্তারকে গ্রেপ্তারের তথ্য দেন কর্মকর্তারা। সিআইডির ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির বলেন, কলাবাগান থানায় এক গ্রাহকের মামলায় ওই দু'জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই প্রতিষ্ঠানটি নানা অফার দিয়ে গ্রাহকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। প্রাথমিকভাবে স্বামী-স্ত্রী কোম্পানির হিসাব থেকে এক কোটি ১৭ লাখ টাকা ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহার করেছে বলে জানা গেছে।

তিনি বলেন, এর আগেও ২৬৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে ২০২০ সালের নভেম্বরে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন আল আমীন। তিনি মূলত ডেসটিনির উচ্চ পর্যায়ের টিম লিডার ও প্রশিক্ষক ছিলেন। ডেসটিনি ও যুবকের আদলেই গড়ে তুলেছেন এসপিসি ওয়ার্ল্ডকে। তাদের বিষয়ে বিস্তারিত তদন্ত চলছে।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আল আমীন সিআইডিকে বলেছেন, বর্তমানে তার প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকসংখ্যা প্রায় এক কোটি। এক মাসের মধ্যে তারা প্রায় পাঁচ থেকে ছয় কোটি টাকার অর্ডার পায়। যারা পণ্য অর্ডার করেন, তাদের বেশিরভাগই ছাত্র ও অল্প বেতনের চাকরিজীবী।

Post a Comment

0 Comments