'ঘুষ না দেওয়ায় জমি রেজিস্ট্রি হয়নি'
'রেট অনুযায়ী ঘুষ না দেওয়ায় ছেলের নামে একটি জমি রেজিস্ট্রি করে দেওয়া হয়নি'- বুধবার যশোরের মনিরামপুরে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্যের দেওয়া এ বক্তব্য ঘিরে তোলপাড় শুরু হয়েছে। এ ঘটনায় গতকাল বৃহস্পতিবার যশোরের জেলা রেজিস্ট্রার ও মনিরামপুর উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রারসহ সাতজনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ (শোকজ) দিয়েছে নিবন্ধন মহাপরিচালকের দপ্তর। এর আগের দিনই মনিরামপুর সাব-রেজিস্ট্রারের কার্যালয় থেকে মোহরার শামসুজ্জামান মিলনকে প্রত্যাহার করে বাঘারপাড়ায় বদলির আদেশ দেওয়া হয়।
তবে প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্যের পর গতকাল ভিন্ন কথা বলেছেন, মনিরামপুর উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার শাহাজান আলী। তার দাবি, প্রতিমন্ত্রী তার বক্তব্যে যে অভিযোগ করেছেন, বাস্তবে তেমন কিছু ঘটেনি।
আন্তর্জাতিক তথ্য অধিকার দিবস উপলক্ষে বুধবার মনিরামপুরে এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য বলেন, 'সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে টাকা ছাড়া কোনো কাজ হয় না। সরকারি প্রতিষ্ঠান মিল্ক্ক ভিটার ফ্যাক্টরি করার জন্য আমি গত সপ্তাহে আমার ছেলের নামে একটি জমি রেজিস্ট্রি করতে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু দুর্নীতির রেট অনুযায়ী টাকা দিতে না পারায় সেই জমি রেজিস্ট্রি হয়নি।'
প্রতিমন্ত্রীর এ বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রচার হলে শুরু হয় তোলপাড়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়ে খবরটি। এর জের ধরে গতকাল সাতজনকে শোকজ করেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নিবন্ধন মহাপরিচালক (আইজিআর) শহিদুল ইসলাম ঝিনুক। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এর জবাব দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। শোকজ নোটিশপ্রাপ্তরা হলেন- যশোরের জেলা রেজিস্ট্রার মো. শাহজাহান সর্দার, মনিরামপুর উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার শাহাজান আলী, মোহরার শামসুজ্জামান মিলন ও তরুণ কুমার, অফিস সহকারী শেখর চন্দ্র দে, পিওন সুশান্ত দাস এবং দলিল লেখক কামরুজ্জামান।
জেলা রেজিস্ট্রার মো. শাহজাহান সর্দার জানান, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শোকজের জবাব পাঠানো হবে। তিনি আরও বলেন, সমবায় প্রতিমন্ত্রী তাকে মনিরামপুরের মোহরার শামসুজ্জামান মিলনের বিরুদ্ধে অশোভন আচরণের অভিযোগ এনে বদলির জন্য অনুরোধ করেছিলেন। বিষয়টি নিবন্ধন মহাপরিচালকের দপ্তরে লিখিতভাবে জানানোর পর বুধবারই মিলনকে বদলি করা হয়।
তবে মনিরামপুর উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার শাহাজান আলীর দাবি, মন্ত্রীকে কেউ ভুল তথ্য সরবরাহ করায় তিনি হয়তো এমন বক্তব্য দিয়েছেন। প্রকৃত ঘটনা হলো, ইউনিয়ন পর্যায়ের জমি বেচাকেনার ক্ষেত্রে মোটমূল্যের সাড়ে ৬ শতাংশ টাকার পে-অর্ডার রেজিস্ট্রির সময় জমা দিতে হয়। কিন্তু গত ১৪ সেপ্টেম্বর দুপুরে পে-অর্ডার ছাড়াই মন্ত্রীপুত্র সুপ্রিয় ভট্টাচার্যের অনুকূলে ২০০ শতক (ছয় বিঘা) জমি রেজিস্ট্রি করার জন্য দলিল জমা দেওয়া হয়। ফলে পে-অর্ডারসহ দলিল জমা দেওয়ার জন্য বলা হয়। বিকেল ৫টায় পে-অর্ডার কপি জমা দিলে সিরিয়াল ভেঙে তৎক্ষণাৎ দলিলটি রেজিস্ট্রি করে দেওয়া হয়। এমনকি রেজিস্ট্রির দুই ঘণ্টার মধ্যে দলিলের নকলও (সার্টিফায়েড কপি) ক্রেতাকে সরবরাহ করা হয়।
মোহরার শামসুজ্জামান মিলন বলেন, সাধারণত দলিল রেজিস্ট্রির পর ১৫ দিনের আগে দলিলের নকল সরবরাহ করা হয় না। কিন্তু প্রতিমন্ত্রীর লোকজনের চাপে নিয়মিত অন্যান্য কাজ বাদ রেখে দুই ঘণ্টার মধ্যে তাদের নকল কপি সরবরাহ করতে বাধ্য হই। এমনকি উপজেলা ভূমি অফিসে নামপত্তনের জন্য ৩০ থেকে ৪৫ কার্যদিবস লেগে গেলেও মন্ত্রীপুত্রের দলিল রেজিস্ট্রির মাত্র তিন দিনের মধ্যে নামপত্তন করে দিতে হয়েছে।
এদিকে মনিরামপুর ভূমি ও রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের একাধিক সূত্র জানায়, স্থানীয় রোহিতা ইউনিয়নের বাসুদেবপুর গ্রামের ৮৪৫ নম্বর খতিয়ানের ৭৬, ৭৭, ৭৯ ও ৮৯ দাগের ২০০ শতক জমি প্রতিমন্ত্রীর পুত্রের নামে ১৪ সেপ্টেম্বর রেজিস্ট্রি করা হয়, যার রেজিস্ট্রি দলিল নম্বর ৭৬৭১। আর এ জমির নামপত্তনের জন্য উপজেলা ভূমি কার্যালয়ে দাখিল করা কেস নম্বর ১২০১ (২০২১-২২)।
ওই জমির বিক্রেতা রোহিতা ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান জানান, মন্ত্রীপুত্র শুভর (সুপ্রিয় ভট্টাচার্য) কাছে তিনি ৮০ লাখ টাকায় জমিটি বিক্রি করেছেন। তবে রেজিস্ট্রি অফিস সূত্রে জানা গেছে, দলিলমূল্য দেখানো হয়েছে মাত্র ১৯ লাখ টাকা।
এদিকে রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের একটি সূত্র জানায়, মন্ত্রীপুত্রের জমি রেজিস্ট্রির জন্য দলিল লেখক কামরুজ্জামানের সহকারী গৌতম ঘোষ বাপী দলিল জমা দিলে মোহরার মিলন সেটা সঠিক কিনা, তা যাচাই করতে চাওয়ায় দু'পক্ষের মধ্যে বিরোধ বাধে। এরপর পে-অর্ডার ছাড়া রেজিস্ট্রি করতে অস্বীকৃতি জানানো এবং তৎক্ষণাৎ নকল কপি সরবরাহ করা নিয়ে আরও ক্ষুব্ধ হন দলিল লেখকরা।
তবে সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য বলেন, ওই অফিসে ঘুষ ছাড়া কাজ করা কঠিন। অফিসের লোকজনের দাবি সঠিক নয়। তার ছেলের দলিল করার জন্য ১০ দিন ধরে ঘুরিয়েছে। পরে এ নিয়ে দলিল লেখকরা কথা বললে তাদের সঙ্গে অসদাচরণ করা হয়। এর প্রতিবাদে সেখানে দলিল লেখকরা কলম-বিরতিও পালন করেছেন। পরে অভিযুক্ত কর্মচারীকে বদলির পর দলিল লেখকরা বৃহস্পতিবার কাজ শুরু করেন।
সরকারি প্রতিষ্ঠান মিল্ক্ক ভিটার নামে কেনা জমি কেন তার ছেলের নামে নিবন্ধন (রেজিস্ট্রি) করা হলো- এমন প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, মিল্ক্ক ভিটার নামে কেনার ক্ষেত্রে কিছু জটিলতা দেখা দিতে পারে। তা ছাড়া সময়সাপেক্ষও। তাই মূলত জমিটা আটকাতে এ পথ নেওয়া হয়।
0 Comments